Corporate News Details

Home | Corporate News Details

স্বাস্থ্যবীমা হলে চিকিৎসা খরচ কমে আসবে

বাংলাদেশে ক্যান্সার চিকিৎসায় বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবার ব্যবস্থাপনা কেমন?

ল্যাবএইড দেশে বেসরকারিভাবে প্রতিষ্ঠিত প্রথম সুপার স্পেশালিটি পূর্ণাঙ্গ হাসপাতাল। ক্যান্সার চিকিৎসায় বহির্বিভাগ থেকে শুরু করে লিনাক কিংবা বোনম্যারো প্রতিস্থাপন, যকৃৎ প্রতিস্থাপনসহ সব সেবা এক ছাদের নিচে হবে। দুই দশক আগে কার্ডিয়াক চিকিৎসার জন্য রোগীরা ভারতে যেতেন। তখন বহির্বিভাগের চিকিৎসা, রোগ নিরীক্ষা, রেডিয়েশন দেয়ার কাজ এক জায়গায় হতো না। আমরা ২০০৩ সালে কার্ডিয়াক হাসপাতাল স্থাপন করে দক্ষ চিকিৎসক, নার্স ও টেকনোলজিস্টদের নিয়ে এক জায়গায় চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছি। এখন কার্ডিয়াক চিকিৎসার জন্য রোগীকে বিদেশে যেতে হয় না। বেসরকারিভাবে ক্যান্সার চিকিৎসার জন্য রোগীরা এক জায়গায় চিকিৎসক, রোগ নির্ণয় সুবিধাসহ প্রয়োজনীয় সব সেবা পান না। এতে রোগীরা দেশের বাইরে চিকিৎসা নিতে যান। আমাদের ক্যান্সার হাসপাতালে পাঁচ-ছয় রকমের চিকিৎসক রয়েছেন। সমন্বিত বোর্ড চিকিৎসা দেয়, পাশাপাশি অন্য চিকিৎসককে রেফার করা যায়। রোগ নির্ণয়, কেমোথেরাপি ও রেডিওথেরাপিসহ সব চিকিৎসা এখানে পাওয়া যায়। ইনডোর চালু হলে জুনে রোগী ভর্তি শুরু হবে।

ক্যান্সার হাসপাতাল প্রতিষ্ঠায় ল্যাবএইডের কি পূর্ব পরিকল্পনা ছিল?

ল্যাবএইড চিকিৎসাসেবায় এসেছে ১৯৮৯ সালে। যেসব বিশেষায়িত সেবা কম তবে চাহিদা বেশি, সেসব ক্ষেত্রে আমরা বিশেষায়িত হাসপাতাল করছি। চিকিৎসার বিষয়ে রোগীরা খুবই দ্বিধাগ্রস্ত থাকে। ক্যান্সার বলেন বা অন্য কোনো জটিল রোগ, মানুষ আক্রান্ত হলে কোথায় যাবে তা জানে না। দেশে অন্যান্য বিশেষায়িত সেবার বিষয়ে কম-বেশি সুবিধা থাকলেও ক্যান্সার চিকিৎসার সুবিধা কম। কিন্তু রোগী অনেক বেশি। বছরে তিন লাখের বেশি মানুষ ক্যান্সার আক্রান্ত হয়, মারা যায় দুই-আড়াই লাখ। এর বাইরে রোগ নির্ণয় হয় না এমন সংখ্যাও অনেক।

ল্যাবএইড গ্রুপে ফার্মাসিউটিক্যালকয়েকটি হাসপাতাল  কৃষিভিত্তিক ব্যবসা রয়েছে। ক্যান্সার হাসপাতাল পরিচালনায় পরিকল্পনা জানতে চাই।

ক্যান্সার চিকিৎসা জটিল বিষয়। শ্রম, সময় ও গবেষণা প্রয়োজন। আমার বড় ছেলে সাকিফ শামীম তিন বছর ধরে হাসপাতালটির সঙ্গে জড়িত। হাসপাতালটি প্রতিষ্ঠায় ওর ইচ্ছা ও আগ্রহ রয়েছে। আমি চেয়ারম্যান থাকলেও সাকিফ ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দায়িত্ব পালন করছে। মূলত সে-ই এ হাসপাতালটির সার্বিক বিষয়গুলো দেখাশোনা করছে। সাকিফ অত্যন্ত ধৈর্য ও নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছে।

দেশে ক্যান্সার রোগীর এক-চতুর্থাংশ চিকিৎসার আওতায় আসছে। সেক্ষেত্রে ল্যাবএইড ক্যান্সার হাসপাতাল কী ভূমিকা রাখবে?

আমাদের ক্যান্সার হাসপাতালটি হবে পূর্ণাঙ্গ বিশেষায়িত হাসপাতাল। এখানে তিনটি লিনাক মেশিনসহ ২০০ শয্যা থাকবে। আমরা উচ্চমধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্তদের চিকিৎসা দিতে পারব। তবে দরিদ্র রোগীদের জন্য আমাদের কিছু ছাড় রয়েছে। এছাড়া যাদের জন্য চিকিৎসা ব্যয় বহন করা কঠিন তাদের জন্য আমরা একটি মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করব। সেখানে সব ধরনের সুবিধা থাকবে।

হাসপাতালটি কাজ শুরু করলে দেশের ক্যান্সার রোগীর কিছু অংশ আমাদের চিকিৎসার আওতায় আসবে। এরপর হয়তো কয়েক বছরের মধ্যে আরো কয়েকটি বেসরকারি ক্যান্সার হাসপাতাল প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাবে। ফলে সামগ্রিকভাবে দেশেই ক্যান্সার চিকিৎসার সুযোগ বাড়বে। তখন দেখা যাবে, পাঁচ-ছয় বছর পর ক্যান্সার রোগীর চিকিৎসার জন্য আর বিদেশে যেতে হবে না। কেবল ক্যান্সার নয়, আমরা স্বাস্থ্যসেবার বিভিন্ন বিষয়ে বেসরকারি খাতের পথপ্রদর্শক। ১৯৮৯ সালে একই ছাতার নিচে দক্ষ চিকিৎসক, ওষুধসহ নানা সেবা দেয়ার কাজ আমরাই প্রথম শুরু করি। একইভাবে কার্ডিয়াক হাসপাতাল আমরা প্রথম করি। আগে সরকারি চিকিৎসকরা বিভিন্ন বেসরকারি হাসপাতালে গিয়ে কাজ করতেন। কিন্তু করপোরেট হাসপাতাল বলতে যা বোঝায় তা এখন হয়েছে। আগে খাবার বাইরে থেকে আসত, নার্সরা পার্টটাইম কাজ করতেন। এখন লন্ড্রি থেকে শুরু করে কিচেন, গ্যাস প্লান্টসহ প্রয়োজনীয় সব হাসপাতালের নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় হচ্ছে।

ক্যান্সার চিকিৎসা ব্যয়বহুল। সরকারি ব্যবস্থাপনার চেয়ে বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় খরচ কয়েক গুণ বেশি।  চিকিৎসাকে সুলভ করার জন্য কী পদক্ষেপ নেয়া যেতে পারে?

সরকারি হাসপাতালে একটি রেডিওথেরাপির জন্য এক থেকে তিন মাস অপেক্ষা করতে হয়। চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে এক মাস সময় লাগে। একজন চিকিৎসকের কাছে আজকে গেলে দুই মাস পর তিনি হয়তো থাকেন না। শয্যা পেতেও কয়েক মাস সময় লাগে। কিন্তু সরকারি হাসপাতালের চেয়ে চার-পাঁচ গুণ ব্যয় বেশি হলেও বেসরকারিতে একসঙ্গে সব চিকিৎসা পাওয়া যায়। পাশাপাশি আনুষঙ্গিক খরচগুলো বেসরকারি হাসপাতালে নেই। তিন মাস চিকিৎসা নিলে বাড়ি থেকে একজন লোক এসে রোগীর সঙ্গে থাকে। এতে কর্মদিবস নষ্ট হয়, বারবার আসা-যাওয়া করতে হয়। এভাবে সরকারি হাসপাতালের চেয়ে বেসরকারি হাসপাতালে খরচ অনেক বেশি না। একই সঙ্গে বেসরকারিভাবে আরো হাসপাতাল হচ্ছে। এতে খরচ কমে যাবে।

তবে এটাও ঠিক, ক্যান্সার চিকিৎসার খরচ অত্যন্ত ব্যয়বহুল। আমরা তিনটি লিনেক মেশিন ৭৫ কোটি টাকা দিয়ে কিনেছি। ৪০ কোটি টাকা দিয়ে একটা রোবোটিক সার্জারি মেশিন কেনার চেষ্টা করছি। যে স্থানে আমরা ক্যান্সার হাসপাতাল করেছি, সেখানে দুই লাখ বর্গফুটের জমি ও ভবনের জন্য ১৫০ কোটি টাকা খরচ হয়ে গেছে। এখানে কোনো ভর্তুকি নেই। কম দামে কোনো জমি পাইনি। ব্যাংকঋণের ক্ষেত্রেও সুদ রয়েছে ১০-১১ শতাংশ হারে। দিন শেষে আমাকে ব্যাংকে টাকা ফেরত দিতে হবে।

ক্যান্সার চিকিৎসায় বেসরকারি ব্যবস্থাপনার প্রতিবন্ধকতা কীসক্ষমতার মধ্যে বেসরকারিভাবে ক্যান্সার চিকিৎসা পাওয়ার ক্ষেত্রে কোনো ব্যবস্থা করা যায় কি?

ক্যান্সার হাসপাতালের বিনিয়োগ অনেক বেশি। কেউ ১০০ শয্যার ক্যান্সার হাসপাতাল করতে চাইলে ২০০-২৫০ কোটি টাকা হাতে রাখতে হবে। এ টাকা ৮-১০ বছরের মধ্যে ফেরত আসে না। দ্বিতীয়ত, ভালো চিকিৎসক, ভালো কেমোথেরাপিস্ট, ফিজিশিয়ান ও নার্স তৈরি হচ্ছে। দেশে এ লোকবল পাওয়ার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা আছে। তৃতীয়ত, মান বজায় রাখা। আমরা আমাদের হাসপাতালটি জয়েন্ট কমিশন ইন্টারন্যাশনালের (জেসিআই) মান অনুযায়ী করছি। এ তিন বিষয়ে আমরা কোনোভাবে আপস করতে পারব না।

অসংক্রামক রোগে মৃত্যুহার বেশি। সেক্ষেত্রে ক্যান্সারেই বছরে প্রায় এক লাখ মানুষের মৃত্যু হয়। যথাযথ চিকিৎসা  রোগ নির্ণয়ের অভাব রয়েছে। ল্যাবএইডের ভূমিকা কী থাকছে?

রোগ নির্ণয় ছাড়াই দেশে ক্যান্সারে প্রচুর লোক মারা যাচ্ছে। দেখা যাচ্ছে জ্বর হচ্ছে, শরীর শুকিয়ে যাওয়ার ছয় মাস পর মারা যাচ্ছে। তার ব্লাড ক্যান্সার, সেটা নির্ণয় করা হয়নি। রক্তবমি, পায়খানার সঙ্গে রক্ত যাওয়া যেমন কোলন ক্যান্সার তাতে বহু লোক মারা গেলেও রোগ নির্ণয় হয়নি। কাশি হলে যক্ষ্মা মনে করা হয়, তবে সেটি ফুসফুসের ক্যান্সার হতে পারে। প্রস্টেট ক্যান্সারে অনেক পুরুষ মারা যায়। ইউটেরাস, স্তন ক্যান্সারে গ্রামের অনেক নারী মারা যায়। লজ্জার কারণে কাউকে বলতে পারে না। অ্যান্টিবায়োটিক খেয়ে কিছুটা ভালো বোধ করলে আর রোগ নির্ণয় হয় না। এ বিষয়ে তাদের সচেতন করতে কাজ করছি। আমাদের একটি দল গ্রামে গিয়ে সচেতনতার কাজ করবে। সামাজিক দায়বদ্ধতার জায়গায় আমরা কাজ করছি। সঠিক সময়ে রোগ নির্ণয় না করা অসংক্রামক রোগে মৃত্যুর বড় কারণ।

বেসরকারি চিকিৎসা খাতে সেবার চেয়ে ব্যবসাকে গুরুত্ব বেশি দেয়া হয়। সেক্ষেত্রে ল্যাবএইডের অবস্থান কী?

মুক্তবাজার অর্থনীতিতে আপনি যদি সঠিক সেবা দেন, কোনো কিছু গোপন না করেন, মানুষ আপনার কাছে আসবেই। কেউ যদি প্রয়োজন ছাড়া সার্জারি করে, ঠিকমতো রোগ নির্ণয় না করে, তাহলে মানুষ জানবে যে সেখানে যথাযথ সেবা দেয়া হয় না। সেক্ষেত্রে ল্যাবএইড প্রথম থেকেই সেবা দিচ্ছে। সেবা দিলে মানুষ মূল্য দেবে। প্রথম প্রজন্ম হওয়ায় বেসরকারি খাতে আমাদের বিনিয়োগটা বেশি। ব্যাংকঋণ নিয়ে বিনিয়োগ করেছি। সেখানে ব্যাংক আমাদের কোনো সুবিধা দেয়নি। পোশাক খাত বা প্রযুক্তি খাতে যে সুবিধা দেয়া হয় তা আমাদের দেয়া হয় না। ব্যাংকের টাকা সময়মতো ফেরত দিতে হলে একটা ফি নিতেই হবে। যদিও ৮০ শতাংশ মানুষের জন্য এ ফি অনেক বেশি। এখানে স্বাস্থ্যবীমা নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। এটাই বড় সমাধান। স্বাস্থ্যবীমা হলে রোগীর ওপর থেকে চাপ অনেকটাই কমে যাবে।

মানুষ চিকিৎসার জন্য এখনো বিদেশমুখী। বিশেষ করে জটিল রোগের জন্য মানুষ বিদেশে যাচ্ছে। দেশের চিকিৎসার ওপর আস্থা নেই বলেই কি তারা বিদেশে যাচ্ছে?

মানুষ ক্যান্সার, কিডনি প্রতিস্থাপন, বড় অর্থোপেডিক সার্জারি ও নিউরোলজিক্যাল চিকিৎসার জন্য বিদেশে যায়। এটা ঠিক যে কিছু চিকিৎসা বাংলাদেশে নেই। তবে এমনও অনেকে আছেন, যারা স্রেফ শখের বশে বিদেশে চিকিৎসার জন্য যান। যেমন কেউ বাচ্চা প্রসবের জন্য যায়, কারণ সেদেশে জন্মসূত্রে সন্তানের নাগরিকত্ব পাওয়া যায়। কিছু ক্ষেত্রে আস্থা না থাকার কারণে মানুষ বিদেশে যায়। গত দুই বছরে করোনার কারণে কেউ বিদেশে চিকিৎসার জন্য যেতে পারেনি। তখন কিন্তু সেসব চিকিৎসা দেশে বন্ধ ছিল না। তখনই প্রমাণ হয়েছে যে দেশে প্রায় সব ধরনের উন্নত চিকিৎসাই দেয়া সম্ভব।

বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় ক্যান্সারসহ প্রায় সব বিষয়ে চিকিৎসা গবেষণার ভূমিকা কম। বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় চিকিৎসা গবেষণা উপেক্ষিত কেন?

আমাদের দেশে এক আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশ (আইসিডিডিআর,বি) ছাড়া তেমন গবেষণা কেন্দ্র নেই। কয়েকটি সংস্থা ও হাসপাতাল কিছু গবেষণা করে। সরকারের উচিত বেসরকারি হাসপাতালের নিবন্ধন দেয়ার ক্ষেত্রে গবেষণার শাখা থাকার বিষয়টি বাধ্যতামূলক করা। সব সরকারি হাসপাতালেও একটা গবেষণা শাখা থাকা উচিত। আমাদের দেশে জনস্বাস্থ্য সবচেয়ে উপেক্ষিত। অথচ জনস্বাস্থ্যবিষয়ক গবেষণা ও কার্যক্রম সারা বিশ্বে অত্যন্ত জরুরি। জনস্বাস্থ্যবিদরা মানুষের স্বাস্থ্যগত সব বিষয়ে প্রয়োজনীয় গবেষণা করে পথ দেখাবেন, স্বাস্থ্য বাজেট ঠিক করবেন; এমনটাই হওয়া উচিত। জনস্বাস্থ্যবিষয়ক গবেষণা বাড়লে রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা ঠিক হবে।